5 ই সেপ্টেম্বর
– সুদীপা ধর
দিন যায়, মাস যায়, বছরগুলো পার হয় বয়সের সাথে, থামিয়ে রাখা যে বড়ো বালাই, দু’টো হলদে চোখের তারায় আজ অনেক স্মৃতি আছে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। কিছু স্মৃতি বড় মধুর, কিছু স্মৃতি ক্ষণিকের, আবার কিছু স্মৃতি আজও বড় কষ্ট দেয় মনকে। আজ আমি বড় একাকী তোমাকে ছাড়া। বড্ডো যেতে ইচ্ছে করে অনুপ তোমার কাছে। তবু যেতে পারিনা আমি। কেননা যমদূত আজ তোমায় নিয়ে গেছে অনেক দূরে। আকাশের তারা করে রেখেছে। আমি রোজ তোমায় দেখি, শত তারাদের মাঝে খুঁজতে থাকি তোমায়। তবু ভাবি কোথায় তুমি? আমি যে বড় নিষ্ঠুর হয়েছিলাম তোমার প্রতি। শুনিনি তোমার ভালোবাসার হাতছানি, তুমি যে চেয়েছিলে আমাকে নিয়ে নীড় গড়তে, কিন্তু গড়া যে আর হয়ে উঠলো না। কিন্তু আজ ভাবি যাদের জন্য করলাম আমি এ জীবন ত্যাগ, তাদের কেউ কি কোনোদিন বুঝবে আমায়, কোনোদিন কোন প্রতিদান দেবে আমাকে!
এত লিখে থামল শ্রীলেখা মিত্র। বয়স তার সত্তর। কাঁচাপাকা চুল, রোগাটে শরীরটা বয়সের ভারে সামান্য স্থূল হয়েছে। কিন্তু অপরূপ সুন্দরী তিনি। এই বয়সেও তা যেন বিদ্যমান। তার জাজ্বল্যমান চোখদুটি এখনো বুদ্ধিদীপ্ত। দোতলা বাড়ি, বাবা মা অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। বাবা-মার একটি সন্তান তিনি। বাড়িটাকে তিনি সাজিয়েছেন অনেক যত্ন করে। তেনার দুটি সাগরেদ- হরি ও জবা। হরি ঘরে বাইরের সমস্ত কাজ করে জবা সামলায় রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া এইসবের ঝক্কি।
শ্রীলেখা মিত্র একজন শিক্ষিকা। রিটায়ার করেছেন। তিনি অনেক ছেলে মেয়েদের নিজের হাতে করে মানুষ করেছেন। অনেক গরীব মানুষ যাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা অনেক কম তাদের বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষা দান করেছন। এইরকম একটা উঁচু মনের মানুষ তিনি। শিক্ষকতা হলো তার ধ্যান জ্ঞান। এর জন্য তিনি হয়তো নিজের দিকে একদম খেয়াল দিতে পারেন নি।
লেখা শেষ করার পর হঠাৎ তার মনে হলো হরিকে তিনি কতগুলো জিনিস আনতে বলেছিলেন। তাই তিনি উঠে গিয়ে-হাঁক দিলেন ‘হরি এই হরি কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না। কোথায় তু্ই?’
‘যাই মা যাচ্ছিই।’
‘কোথায় থাকিস তু্ই ডাকলে সাড়া পাওয়া যায় না।’
‘না মানে ওই একটু………’
‘থাক আর মানে মানে করতে হবে না। শোন্ আজ কত তারিখ মনে আছে তো?’
‘১লা সেপ্টেম্বর।’
‘আমি ভাবলাম তু্ই হয়তো ভুলে গেলি।’
‘না মা ভুলিনি, আজ অনুপ দাদাবাবুর জন্মদিন।’
‘মিষ্টি মালা সব এনেছিস তো।’
‘হ্যাঁ মা এনেছি। নিচে আছে নিয়ে আসছি।’
‘শোন্ জবাকে বলিস পায়েস রাঁধবার জন্য ও যে বড্ডো ভালোবাসতো খেতে।’
‘বলবো। একটা কথা বলবো মা, আপনি আজও অনুপ দাদাবাবুকে ভুলতে পারেননি। দাদাবাবু কত চেয়েছিল আপনাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে, সংসার করবে, কিন্তু আপনি তার কোনূ স্বপ্নই সত্যি করলেন না। ছোট মুখে বড় কথা খুব অনাচার হয়েছে তার প্রতি।’
( দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) ‘হ্যাঁ হয়েছে। আজ আমি বুঝি, সেই দিনগূলোতে বুঝিনি, বুঝতে চাইনি। তখন ছোট বড় সব সবুজের দলগুলিকে নিয়েই আমার সংসার ছিল। তুই এই বাড়িতে অনেকদিনের হয়ে গেলি তাই তোকে বলতে আপত্তি নেই, আর কাকেই বা বলবো– জানিস ও বলেছিল বিয়ের পর তুমি পড়াবে, আমার বা আমার বাড়ি তরফ থেকে কোনো আপত্তি থাকবেনা। কিন্তু আমি শুনিনি তার কথা, বুঝিনি কি পরিমাণ সে আমাকে ভালোবাসতো। আমার জন্য সে আর কারো সাথে ঘর বাধলো না। আজ নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। যতদিন বেঁচে ছিল অনুপ ততদিন ছায়ার মতো সঙ্গী হয়ে থেকে ছিল আমার সঙ্গে। ( কাঁদতে কাঁদতে) তারপর একদিন একা করে দিয়ে চলে যায়।’
‘মা আপনি কাঁদবেন না।’
‘জানিস হরি এই যে ছাত্রছাত্রীরা এখনো মাঝে মধ্যে দেখা করতে আসে বটে, কিন্তু একাকীত্ব যে যায়না। ঠাকুর যে কবে আমাকে নেবেন।’
‘ছিঃ মা এসব কথা বলতে নেই। মন খারাপ করবেন না একদিন ঠিকই কিছু হবে। যাই সবকিছু নিয়ে আসি।’
এই ভাবেই শ্রীলেখা মিত্রের সময়গুলো কেটে যায় স্মৃতি রোমন্থন করে, বই পড়ে, কবিতা পাঠ করে। দুদিন পর একটা ঘটনা ঘটলো।
টিং টং
‘হরি দেখ তো কে এসেছে?’
দরজা খুলে হরি দেখে এক সুদর্শন পুরুষ আর তার সাথে একজন সুন্দরী মহিলা দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে হাসছে। সুদর্শন পুরুষটি প্রথম কথা বললো, ‘হরি কাকা চিনতে পারছ?’
‘না মানে ঠিক—- কে বলুন তো আপনারা?’
(মেয়েটি হেসে বলল)’ এ বাবা তুমি ভুলে গেলে। ঠিক আছে এখন সরো তো দেখি যার কাছে আসা তার ঠিক মনে আছে কিনা আমাদের।’
‘মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন? তিনি তো উপরে আছেন। আপনাদের কি নাম বলবো একটু বলুন না।আসলে অচেনা কাউকে—–‘
‘সুদর্শন পুরুষটি বলল, অচেনা নই গো আমরা তুমি সরো তো এখন।’
ছেলে ও মেয়েটি হরিকে সরিয়ে দিয়ে তরতর করে ওপরে চলে গেল। শ্রীলেখা মিত্র কিছু বোঝার আগেই দুজনে নমস্কার করলো।
‘আরে আরে করছো কি? কে তোমরা?’
‘যুবকটি বলল ভালো করে চেয়ে দেখুন তো কে আমরা।’
শ্রীলেখা মিত্র চশমার কাঁচটা ভালো করে মুছে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন দুজনের দিকে। তারপর উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘আরে তুই—-ই ঋদ্ধি তো?’
মেয়েটি বললো–‘ আমাকে ভুলে গেলেন?’
‘আরে কি করে ভুলবো, তুইতো শ্রেয়া।’
‘সেই যে দুজনে বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেলি তারপর ছয় বছর বাদে দেখা।’
ঋদ্ধি বললো, ‘হ্যাঁ ম্যাম অনেকদিন বাদে ফিরলাম। আর যাবো না আমরা। এই বঙ্গদেশকে ভুলে থাকতে পারছি না। তাই পোস্টিং নিয়ে এখানে চলে এসেছি।’
‘জবা এই জবা, ওপরে একবার শুনে যা।’
‘আসতাছি। বলেন মা।’
‘শোন আজ ভাল ভাল রান্না কর। মাছ, মাংস, সোনামুগের ডাল চাটনি আর হরিকে বল মিষ্টি আনতে।’
শ্রেয়া বললো- কি করছেন আপনি? আমরা শুধু গল্প করবো, খাওয়া-দাওয়া আরেকদিন হবে।’
‘ নানা আজ আমার বড় আনন্দের দিন। বোস বোস ওফ তোরা হলি আমার সেই ছাত্র ছাত্রী, যাদের জন্য আমার গর্ব বোধ হয়। তোরা ছিলিস আমার প্রিয় ছাত্র ছাত্রী। পঞ্চম ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলিস আর সেই বারো ক্লাস অব্দি রয়ে গেলি। কখন যে তোরা দুজন দুজনকে পছন্দ করলি তা বুঝতেই পারিনি কোনদিন। আসলে আমি প্রেম ভালোবাসা বলে কিছু জানতাম না( দু ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো), নাহলে কি অনুপ অভিমান করে আমায় ছেড়ে চলে যায়।
শ্রেয়া বললো, ‘বুঝলাম না ঠিক, নেই মানে’।
‘ওই তোরা যে বছরে আমেরিকা গেলি তার পরের বছরই উনি পরলোক গমন করলেন।’
ঋদ্ধি বললো, ‘খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমরা ভেবেছিলাম দুজনের সাথে বোধহয় দেখা হবে। আসলে আমরা অনেকবার ফোনে ট্রাই করেছিলাম কিন্তু কিছুতেই আপনার নাম্বারে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। সেই জন্যই হয়তো কোন খবর পাইনি।’
‘হ্যাঁরে, অনুপ চলে যাবার পর আমি আমার ফোন নাম্বারটা পাল্টে নিয়েছিলাম। ভালো লাগতো না কারো সাথে কথা বলতে। আসলে কথা বলতে গেলেই সবাই বলে আমি জীবনে কত বড় ভুল করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। এই গুটিকয়েক ছাত্রছাত্রীরা মাঝে মাঝে দেখা করতে আসে তখনই একটু কথা বলি। এই করেই আমার চলে। যাকগে এই বুড়িটার কথা না শুনে তোদের কথা বল।’
ঋদ্ধি বললো, ‘আমরা সবাই ঠিক আছি ম্যাম’
এইভাবে দুপুরে জমিয়ে খাওয়া দাওয়ার পর অনেক পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করল সবাই মিলে।
ঋদ্ধি বললো, ‘আজ তাহলে আসি। তিন দিন পর আসবো, আপনাকে একটি সারপ্রাইজ দেবো।’
এই বলে তারা চলে যায়।
তিনদিন পর
ডোরবেল এর শব্দ টিং টং
হরি দরজা খুলে দেখে ঋদ্ধি।
‘এস দাদাবাবু ভেতরে এসো। তুমি সাহেবদের মতো হয়ে গেছো তো তাই সেদিন চিনতে পারিনি।’
শ্রীলেখা মিত্র উপর থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে রে হরি?’
‘আমি ঋদ্ধি।’
‘আয় আয় ওপরে আয়। শ্রেয়া কোথায়?’
‘আছে গাড়িতে বসে।’
‘কেন আসবেনা?’
‘না। আপনি দশ মিনিটে রেডি হয়ে নিন।’
‘কেন কোথায় যাব?’
‘নো কোয়েশ্চেন।’
তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে শ্রীলেখা মিত্র নিচে নেমে এলেন। আজও ওনাকে সাজলে কি সুন্দরই না লাগে। বললেন, ‘কোথায় যাবি চল।’
‘হু চলুন।’
‘আসুন ম্যাডাম ঢুকে আসুন।’ শ্রেয়া বললো
হু হু করে গাড়িটা চলতে শুরু করলো। থামল একটা বিরাট গেটের সামনে। শ্রীলেখা মিত্র গাড়ি থেকে নেমে হোডিংটা পড়লেন,
‘ শ্রীনিকেতন চ্যারিটি। এখানে কি করতে?’
ঋদ্ধি বললো, ‘আমেরিকা থেকে ফেরার পর আমরা এই চ্যারিটি সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। এখানে এসে দেখেছি ম্যাম এই বাচ্চালো খুব অসহায়। এদের আরো যত্নের সাথে সব কিছুর প্রয়োজন। যে মানুষগুলো বিনা স্বার্থে সব কিছু উজার করে শিক্ষা দেবে, আলো দেখাবে ভবিষ্যতের, তারা নতুন করে পথ চলতে শিখবে, সেইরকম মানুষদের খুব দরকার। তার মধ্যে একজন হলেন আপনি। আপনার মনে আছে ম্যাম আমার বাবার অবস্থা ভাল ছিল না বলে যতবছর পড়িয়েছেন আপনি কোনো টিউশন ফি নেন নি আমার কাছ থেকে। আপনি আমার আর এক মা। কাল থেকেই এই চ্যারিটিতে কখনো আমি কখনো শ্রেয়া যে যখন সময় পাব আপনাকে নিয়ে আসবো। আপনি নতুন ভাবে আবার মানুষ করবেন, নতুন আশার আলো দেখাবেন, আরো ঋদ্ধি আরো শ্রেয়া তৈরি করবেন। আপনি একা নন, আমরা সবাই আছি আপনার পাশে, আর এই শিক্ষক দিবসে এটাই আমাদের গুরুদক্ষিণা। চলুন ভেতরে কথা বলে আসি।’
‘ম্যাম আপনি কাঁদছেন’ শ্রেয়া বললো।
‘নারে আনন্দের জল। আজকের দিনে তোরা আমাকে এত সুন্দর উপহার দিলি, তোরাই যে আমার ছেলে মেয়ে, আমার আর কোন অভাব রইল না রে। আয় আমার বুকে আয় তোরা।’
ভেতরে ঢুকে কথা বলে বেরিয়ে শ্রেয়াই বললো-‘চলুন আজ আমরা তিনজনে কোথায় ঘুরে খেয়েদেয়ে একদম বাড়ি ফিরবো।’
শ্রীলেখা মিত্র বললেন, ‘চল যাবি তোরা। অনেকদিন কোথাও বেরোইনি।’
গাড়িতে উঠে বসে ঋদ্ধি বললো- ‘এই ছোট্ট উপহার কেমন লাগলো ম্যাম?’
শ্রীলেখা মিত্র গাড়ির জানলাগুলো খুলে দিয়েছেন, বললেন, ‘এই সময় আমার রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার কয়েক ছত্র লাইন মনে পড়ছে। খুব আবৃত্তি করতে ইচ্ছা করছে।’
শ্রেয়া বললো, ‘করুন না ম্যাম, আপনি তো আমাদের কত ভালো আবৃত্তি শেখাতেন। প্লিজ শুরু করুন।’
“আকাশ তবু সুনীল থাকে
মধুর ঠেকে ভোরের আলো
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।”
আমি আর মৃত্যু কামনা করতে চাই না রে। আজকের দিনটি থেকে বাঁচতে চাই তোদের সাথে, হাত ধরে। বাঁচতে চাই আমি।
Khub sundar sudipa lekhata.